ডাক নাম রেনু। একভাই ও দুই বোনের মধ্যে ছিলেন সবার ছোট। মাত্র ৩ বছর বয়সে বাবা শেখ জহুরুল হক ও ৫ বছর বয়সে মা হোসনে আরা বেগম পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। বাবা-মাকে হারানোর পর শেখ ফজিলাতুন্নেছা বেড়ে ওঠেন দাদা শেখ কাশেমের কাছে।
মাতৃস্নেহে আগলে রাখেন তার চাচি এবং পরবর্তীতে শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুর মা সায়েরা খাতুন। পিতার অভাব বুঝতে দেননি বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান। তাদের আদরেই বড় হয়ে ওঠেন তিনি। নিজের সন্তানদের সঙ্গে শেখ ফজিলাতুন্নেছাকেও ভর্তি করিয়ে দেন স্থানীয় মিশনারি স্কুলে।
গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়ার সময় দাদা শেখ কাসেম চাচাতো ভাই শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মাত্র ১৩ বছর বয়সে ফজিলাতুন্নেছার বিয়ে দেন। বিয়ের পর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া আর করা হয়নি। তবে ঘরে বসেই পড়াশোনা করেছেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই তিনি দায়িত্বশীল ছিলেন স্বামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নানা পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়ে লড়াই-সংগ্রামের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী, মহীয়সী নারী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে পেছন থেকে কাজ করেছেন তিনি। তার কারণেই একটি জাতির মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন বপন করে এর স্বাদও এনে দিতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ সহ তৎকালীন সব সংগ্রামে তিনি গণমানুষের পক্ষে নিজ অবস্থান ব্যক্ত করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর জীবনে সমস্যা-সংকটে তিনি যেমন পরিবারের দায়িত্ব পালন করেছেন পরম মমতায়, তেমনি সাংগঠনিক দায়িত্বও পালন করেছেন যথেষ্ট সাহসিকতার সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দিকনির্দেশনা দিয়ে দলীয় নেতা-কর্মী ও অনুসারীদের সক্রিয় রেখেছেন বঙ্গমাতা।
ইতিহাসে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কেবল একজন রাষ্ট্রনায়কের সহধর্মিণীই নন, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে অন্যতম এক নেপথ্য অনুপ্রেরণাদাত্রী। বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি বঙ্গবন্ধুকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন। অনুসরণ করেছেন স্বামী বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে। এই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্যও অবদান রেখেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের ক্ষেত্রেও রয়েছে বঙ্গমাতার বুদ্ধিমত্তার ছাপ। বঙ্গবন্ধুর পরামর্শক হিসেবে বিবেচনা করা যায় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে। ফজিলাতুন্নেছা মুজিবই তাকে বলেছিলেন, “কারো নির্দেশনা বা পরামর্শ নয়, তোমার যা মনে আসে তাই বলো।”
তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে উত্তাল জনসমুদ্রে তর্জনি উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন, “এবারের সংগ্রাম- আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তার সেই ডাকেই স্বাধীনতার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ডাকে ছিল বঙ্গমাতার মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন। এই সমর্থন বঙ্গবন্ধুকে সাহস জুগিয়েছিল। ১৯ মিনিটের সে ভাষণটি আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাস অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্য্য নিয়ে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। এই সময়টায় অনেকটা বন্দিদশায় কেটেছে তাদের। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
আন্তর্জাতিকভাবে দেশকে তুলে ধরতেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অবদান রেখেছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বাঙালি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে ধাপে বঙ্গমাতার অবদান রয়েছে। বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ মুজিবের বাঙালি জাতিরজনক হয়ে ওঠার পেছনে যার অবদান এবং অনুপ্রেরণা অনস্বীকার্য তিনি শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর অনন্য সাধারণ ভূমিকার জন্য চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এই মহীয়সী নারী ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সপরিবারে খুনিচক্রের বুলেটের আঘাতে নির্মমভাবে শহীদ হন।
লেখক,
মোঃ বাইজীদ হোসেন সা’দ
টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ
৮ আগস্ট, ২০২১
লেখাটি প্রকাশিতঃ